যাকাত: ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ ও মানবিক দায়িত্ব
হাদিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাযাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। এটি শুধু একটি আর্থিক দান নয়, বরং একটি সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। যাকাতের মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্রের মাঝে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত হয়, যা সমাজে ন্যায্যতা ও সমতা প্রতিষ্ঠা করে।
প্রিয় পাঠক, যাকাত শুধুমাত্র আর্থিক সহায়তা নয়; এটি সামাজিক সাম্য, ন্যায়পরায়ণতা ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় যাকাতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিসীম। নিম্নে যাকাতের হুকুম, শর্ত, খাত, গুরুত্ব ও পরিণাম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
পেজ সূচীপত্রঃযাকাত: ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ ও মানবিক দায়িত্ব
যাকাত ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এটি কেবল একটি আর্থিক দায়বদ্ধতা নয়, বরং মুসলমানের আত্মশুদ্ধি এবং সমাজের দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি মানবিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যম। যাকাতের মাধ্যমে সমাজে সম্পদের সুষম বণ্টন ঘটে, যা সামাজিক সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। এটি ব্যক্তি ও সমাজ দুটো ক্ষেত্রেই পরোপকার ও নৈতিক উন্নতির পথ প্রশস্ত করে।
দারিদ্র বিমোচিত ইসলামের যাকাতের ভূমিকা অপরিসীম। পৃথিবীকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনার জন্য আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। এক, গরিব শ্রেণী। দুই, ধনী শ্রেণী। এর কতগুলো বিশেষ কারণ রয়েছে। নতুবা আল্লাহ ইচ্ছা করলে সমগ্র মানবজাতিকে এক স্তরে সৃষ্টি করতে পারতেন।
কিন্তু তিনি করেননি এর কারণ আল্লাহ সুবহানাহুওয়া বলেন, আমি দুনিয়ার জীবনে তাদের মধ্যে জীবিকা বন্টন করে দেই এবং তাদের একজনকে অপরজনের ওপর মর্যাদায় উন্নীত করি যাতে একে অপরকে অধীনস্থ হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। (সূরা যুখরুফ ৩২)।
আরো পড়ুনঃ ইস্তেগফার এর উপকারিতা: দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য আল্লাহর রহমতের চাবিকাঠি
এই আয়াত দ্বারা বুঝা গেল যে, ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য সৃষ্টিগত। যাতে ধনীরা গরীবদেরকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতে পারে, নতুবা সকলেই যদি ধনী হতো তাহলে সুইপার, কুলি, ধোপা, নাপিত ও মজদুর কোথাও পাওয়া যেত না। তাছাড়া এর মাধ্যমে আল্লাহ মানব জাতিকে পরীক্ষাও করেছেন। যাতে আল্লাহ যাদের নেয়ামত দিয়েছে তারা আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করে কিনা এই জন্য?
যাকাতঃ যাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, البركة মানে বরকত, النماء মানে বৃদ্ধি, الطهارة মানে পবিত্রতা, الصلاح মানে পরিশুদ্ধতা ইত্যাদি।
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, যাকাতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম নাসির উদ্দিন আলবানী বলেন,
الزكاه شرعا حصة مقدرة من مال مخصوص في وقت مخصص يصرف في جهات مخصوصة
"অর্থাৎ, নির্দিষ্ট সম্পদে বা (নেসাব পরিমাণ মালে) নির্দিষ্ট সময়ে (চন্দ্র মাস হিসেবে বছর পূর্ণ হলে) নির্দিষ্ট খাতে (কুরআনে বর্ণিত ৮টি খাতে) ব্যয় করার জন্য নির্দিষ্ট অংশ আদায় করার নাম যাকাত।" (সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ, আলবানী, ২/৫)।
যাকাতের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থের মধ্যে সম্পর্ক , যিনি যাকাত দিবেন যাকাত দেওয়ার কারণে তার সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, পবিত্র হবে ও তাতে বরকত হবে। এছাড়া ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, যাকাতের মাধ্যমে যাকাত প্রদানকারীর মন পবিত্র হয় এবং তার সম্পদে বরকত হয় ও বৃদ্ধি পায়। সাথে উহা বালা-মুসিবত থেকেও রক্ষা করে। (মাজমূউল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ৫/৪৯২)।
ইসলামের যাকাতের হুকুম বা বিধান
ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী যার উপর যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তাবলী পাওয়া যাবে তার ওপর যাকাত ফরজে আইন এবং এটি ইসলামের একটি মহান রুকন। কুরআন, হাদিস এবং ইজমা দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত।
ইসলামে যাকাত একটি ফরজ ইবাদত, যা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশানুসারে মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক। এটি শুধু অর্থদানের মাধ্যম নয়, বরং এটি নেকি, পরিশুদ্ধি ও সামাজিক দায়িত্ববোধের প্রতীক। কুরআন ও হাদিসে যাকাতের গুরুত্ব বারবার জোর দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে এবং যাকাত না দেয়াকে বড় পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
কুরআনিক বিধান
কুরআনে আল্লাহ বলেন:
"নিশ্চয়ই সালাত অপরাধদমনের এবং যাকাত সম্পদের জন্য পবিত্রতা এবং বৃদ্ধি।"
— [সূরা ত্বাহা, আয়াত ৭২]
এছাড়া বহু আয়াতে যাকাত আদায়ের জোরালো নির্দেশনা ও বর্ণনা পাওয়া যায়।
হাদিসে যাকাতের গুরুত্ব
হাদিস শরীফে নবী করিম (সা.) বলেন:
"ইসলাম পাঁচ স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যার মধ্যে যাকাত অন্যতম।"
— (সহীহ বুখারি)
যাকাত আদায় না করলে কঠোর শাস্তির কথা হাদিসে উল্লেখ রয়েছে।
কুরআনের দলিলঃ পবিত্র কুরআনে অসংখ্য স্থানে আল্লাহ তায়ালা যাকাত ফরজ হওয়া এবং তার গুরুত্বের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ বলেছেন, তোমরা সালাত কায়েম করো ও যাকাত দাও। এখানে সালাতের সাথে যাকাত প্রদান করতে আদেশ করা হয়েছে। আরবি এবারত বা আয়াত হচ্ছে,
واقيموا الصلاة واتوا الزكاة
অর্থাৎ, আর তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও।
এখানে সালাতের সাথে যাকাত প্রদান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে,
خذ من اموالهم صدقة تطهرهم وتزكيهم بها وصل عليهم ان صلاتك سكن لهم والله سميع عليم
অর্থাৎ, তাদের সম্পদ থেকে সদাকা তথা যাকাত নাও, এবং এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে। আর তাদের জন্য দোয়া করবে যে, নিশ্চয়ই তোমার দোয়া তাদের জন্য প্রশান্তিকর। আর আল্লাহ হচ্ছেন সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। (সূরা তাওবা ১০৩)।
অত্র আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, যাকাত প্রদানের মাধ্যমে মাল পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয়, আর তখন দোয়া করলে দোয়া কবুল হয়।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত সমূহ
যাকাত ফরজ হওয়ার পাঁচটি শর্ত
১. মুসলিম হওয়া
যাকাত দিতে হলে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে। অমুসলিমের ওপর যাকাত ফরজ নয়।
২. সম্পদের মালিকানা থাকা
আপনার সম্পদের পূর্ণ মালিকানা থাকতে হবে। দাস বা অন্য কারো সম্পদে যাকাত দিতে হয় না।
৩. নিসাবের সমপরিমাণ সম্পদ থাকা
যাকাত দিতে হলে আপনার কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে, যাকে নিসাব বলা হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যেমন বাড়ি, পোশাক, আসবাবপত্র এর মধ্যে পড়ে না।
৪. সম্পদে পূর্ণ দখল থাকা
যে সম্পদের ওপর যাকাত দিতে চান, সেটি আপনার হাতে বা নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। সরকার বা অন্য কেউ যদি আগেই কিছু কাটে, তার ওপর যাকাত দিতে হয় না।
৫. এক বছর সম্পূর্ণ হওয়া
নিসাবের পরিমাণ সম্পদ যদি এক বছর আপনার কাছে থাকে, তখন যাকাত ফরজ হয়। তবে ফসল ও গবাদিপশুর যাকাত এর বাইরে।
হানাফী মাযহাব অনুযায়ী অতিরিক্ত শর্ত
হানাফী মাযহাবের মতে, যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য একজন ব্যক্তি অবশ্যই বালিগ (প্রাপ্তবয়স্ক) এবং আকিল (জ্ঞানী) হতে হবে। অর্থাৎ, যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে শুধু সম্পদের পরিমাণই নয়, ব্যক্তির বয়স ও জ্ঞান থাকাও শর্ত। কারণ শরীয়তের বিধান অনুসারে ফরজ ইবাদত সম্পূর্ণ করার জন্য বালিগ ও সজ্ঞান হওয়া জরুরি।
তবে, অন্যান্য ইমাম, ফক্বীহ ও মুহাদ্দিসগণের মতে, নাবালক বা শিশুদের মালেও যাকাত ফরজ হতে পারে। তাদের দলীল হিসেবে একটি হাদিস উল্লেখ করা হয়, যেখানে সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যিব থেকে বর্ণিত, ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বলেছেন:
"তোমরা এতিমের মাল দিয়ে ব্যবসা করো, যাতে যাকাত সম্পদের পুরোটা খেয়ে না ফেলে।"
— (সুনানে বাইহাকী)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, শিশুদের মাল থেকেও যাকাত আদায় করা হয়। কারণ ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এমন নির্দেশ দিতেন।
হানাফী মাযহাব এই হাদিসটিকে দুর্বল বলে বিবেচনা করে এবং তাই এর ওপর আমল করে না। কিন্তু তারা যাকাতের ফরজিয়তের জন্য বালিগ ও আকিল হওয়ার শর্ত যথাযথ বলে মনে করে। যদিও তিরমিজি শরীফে যে হাদিসটি এসেছে তা দুর্বল, বাইহাকী শরীফে বর্ণিত হাদিসটি সহীহ সনদবিশিষ্ট।
এছাড়া যাকাতের ফরজিয়ত প্রতিষ্ঠিত অনেক আয়াত ও হাদিসে স্পষ্ট করা হয়েছে, যাকাত ধনী ব্যক্তিদের সম্পদের ওপর আদায় করা হবে। সেখানে কোনো প্রকার বয়সভিত্তিক পার্থক্য করা হয়নি। তাই, শিশু হোক বা প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের মাল নিসাবের সমপরিমাণ বা বেশি, তাদের মাল থেকে যাকাত আদায় হবে।
যাকাতের নিসাব
ইসলামে যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য যে পরিমাণ সম্পদের উপস্থিতি আবশ্যক, সেটাই নিসাব বলে। নিসাবের অর্থ হলো যাকাত আদায় করার জন্য ন্যূনতম সম্পদের মান বা সীমা, যা একজন মুসলিমের মালিকানায় থাকতে হবে এবং সেই সম্পদ এক বছর (হিজরি বছর) পূর্ণ হতে হবে।
নিসাবের গুরুত্ব
নিসাব নির্ধারণ করার উদ্দেশ্য হলো যাকাতের ফরজিওয়াতের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি সনাক্ত করা। যারা এই নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ বা তার বেশি সম্পদ ধরে রাখেন এবং এক বছর পর্যন্ত তাদের মালিকানা থাকে, তাদের ওপর যাকাত ফরজ হয়। যারা এই পরিমাণের নিচে সম্পদ রাখেন তাদের ওপর যাকাত ফরজ নয়।
নিসাবের পরিমাণ
ইসলামী শরীয়তে নিসাব নির্ধারণ করা হয়েছে স্বর্ণ, রূপা, বা সোনা ও চামড়ার সমমূল্যের হিসেবে। সাধারণত:
- স্বর্ণের নিসাব: ৮৫ গ্রামের খাঁটি স্বর্ণ (প্রায় ২০ তোলা স্বর্ণ)।
- রূপার নিসাব: ৫০০ গ্রাম রূপা।
- অন্যান্য সম্পদ: নগদ টাকা, বাণিজ্যিক মালপত্র, জমি বা অন্য যে কোনো সম্পদ যার বাজার মূল্য স্বর্ণ বা রূপার নিসাবের সমমূল্য।
নিসাবের হিসাব ও প্রযোজ্য সময়
একবার যখন কোনো ব্যক্তির সম্পদের মূল্য নিসাবের সমান বা তার বেশি হয় এবং সেই সম্পদ তিনি এক বছর ধরে মালিকানায় রাখেন, তখন তার ওপর যাকাত ফরজ হয়। যদি সম্পদ এক বছরের মধ্যে কমে যায় বা নষ্ট হয়, তাহলে যাকাত ফরজ হয় না।
উদাহরণ
যদি কোনো ব্যক্তির কাছে ৮৫ গ্রামের স্বর্ণের সমমূল্যের নগদ টাকা থাকে এবং সে এক বছর ধরে সেটি নিজের কাছে রাখে, তাহলে তার ওপর যাকাত পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক।
যাকাত বিতরণের খাতসমূহ
পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে ৮ শ্রেণীর লোক যাকাতের মাল পাওয়ার যোগ্য বা হকদার হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। এরা হলো যাদের সাহায্য করার জন্য যাকাত বিতরণ করা হয়। নিচে এই আটটি খাতের বর্ণনা দেওয়া হলো:
১. الفقراء (গরিব সম্প্রদায়)
যারা সম্পূর্ণ দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনযাপন করেন, তাদের জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য যাকাত বিতরণ করা হয়।
২. المساكين (অভাবগ্রস্থ ব্যক্তিবর্গ)
যারা গরিবের চেয়ে সামান্য ভালো অবস্থায় থাকলেও দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে কষ্ট পান, তাদের জন্য যাকাত বরাদ্দ থাকে।
৩. العاملين عليها (যাকাত প্রশাসনে নিয়োজিত ব্যক্তি)
যারা যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণে নিয়োজিত, তাদের জন্য নির্দিষ্ট অংশ রাখা হয়।
৪. المؤلفة قلوبهم (যাদের মন জয় করা যায়)
যারা ইসলামে নতুন আসে বা যারা ইসলামে আগ্রহী তাদের সাহায্য করার জন্য যাকাত দেয়া হয়।
৫. في الرقاب (দাস মুক্তি)
দাস-দাসী মুক্তির জন্য নির্ধারিত যাকাতের অংশ। বর্তমানে দাসপ্রথা কম থাকায় এই অংশ অন্যান্য খাতে ব্যয় করা যেতে পারে। কিছু আলেমের মতে, যারা আল্লাহর পথে বন্দী হয়েছেন, তাদের মুক্তির জন্যও এই অর্থ ব্যয় করা যায়।
৬. الغارمين (ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি)
যারা নিজের প্রয়োজনীয় খরচ চালানোর জন্য ঋণগ্রস্ত, তাদের ঋণ মেটাতে সাহায্য করা হয়।
৭. في سبيل الله (আল্লাহর পথে যোদ্ধা)
যারা ইসলামের প্রতিরক্ষা, প্রসার ও বিজয়ের জন্য যুদ্ধ করছেন বা ইসলামিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত, তাদের জন্য যাকাত বিতরণ করা হয়।
৮. ابن السبيل (পথচারী বা মুসাফির)
যারা পথে ভ্রাম্যমান এবং তাদের জন্য সাহায্যের প্রয়োজন, তাদের জন্য যাকাত নির্ধারিত।
যাকাত আদায় না করার ভয়াবহ পরিণতি
ইসলামে যাকাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত, যা আদায় করা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। যারা যাকাত দিতে এড়িয়ে যান বা তা অমান্য করেন এবং আল্লাহর দেয়া হক থেকে কৃপণতা দেখান, তাদের জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারিত আছে। এই শাস্তি মূলত দুই প্রকার:
১) ইহকালীন শাস্তি
২) পরকালীন শাস্তি
ইহকালীন শাস্তি
ইহকালীন শাস্তি আবার দুই ভাগে বিভক্ত:
আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত শাস্তি
ইসলামী প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রদত্ত শাস্তি
আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যাদের যাকাত দেওয়া থেকে বিরত থাকেন, তাদের জন্য দুনিয়াতে নানা ধরনের দুর্ভোগ বয়ে আনা হয়। যেমন, অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ইত্যাদি।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
عن بريدة ما منع قوم الزكاة الا ابتلاهم الله بالسين وفي رواية الاحبس عنهم القطر
অর্থাৎ, বুরাইদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, যখন কোনো জাতি যাকাত দিতে অবহেলা করে, তখন আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে দুর্ভিক্ষ এবং অনাবৃষ্টিতে দন্ডিত করেন।
— (তাবারানী, হা/৪৫৭৭)
বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা যথাযথভাবে যাকাত আদায়ের গুরুত্ব দেয় না এবং এর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। যার ফলে সমাজে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এটি আল্লাহর নাকচ করার পরিণতি হিসেবে আমাদের ওপর নেমে আসা গজব ও আজাবেরই প্রকাশ।
যাকাত আদায়ের গুরুত্ব আমাদের বুঝতে হবে এবং তা পালন করাই সফল ও শান্তিপূর্ণ জীবনের সেতু। না হলে দুনিয়া-আখেরাতে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।
ইসলামী প্রশাসনের পক্ষ থেকে শাস্তি
ইসলামী শরীয়তে যাকাত আদায় শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব নয়, বরং একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তব্য। যাকাত আদায়ে বাধা প্রদান বা তা পরিশোধে অবহেলা করলে ইসলামী প্রশাসন কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর উদ্দেশ্য হলো দরিদ্রদের অধিকার রক্ষা এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।
কুরআন থেকে দলীল
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
— (সূরা আত-তারিক, আয়াত ৩৫)
অর্থ:
“আর যারা স্বর্ণ-রূপা জমা করে রাখে এবং আল্লাহর পথে তা খরচ করে না, তাদেরকে ব্যথাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও।”
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِنَ اللَّهِ
— (সূরা আত-তাওবা, আয়াত ৬০)
অর্থ:
“যাকাত তো কেবল গরিব, দরিদ্র, যাকাত সংগ্রাহক, মন জয়কারীদের জন্য, দাস মুক্তি, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর পথে লড়াই করা এবং পথচারীর জন্য ফরজ করা হয়েছে; এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত একটি বাধ্যবাধকতা।”
হাদিস থেকে দলীল
مَن مَنَعَ زَكَاةَ مَالِهِ فَسَوْفَ يُعَذِّبُهُ اللَّهُ بِهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ
— (সহীহ মুসলিম)
অর্থ:
“যে ব্যক্তি তার মাল থেকে যাকাত দিতে বিরত থাকে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিনে তার সেই মাল দিয়ে শাস্তি দেবেন।”
ইসলামী প্রশাসনের শাস্তি
ইসলামী শাসক যাকাত আদায়ে বাধা প্রদান বা দুর্নীতি করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, যেমন:
- অর্থদণ্ড বা জরিমানা
- সম্পদ বাজেয়াপ্ত
- কারাদণ্ড
- সামাজিক নিষেধাজ্ঞা
এসব ব্যবস্থা সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও দরিদ্রদের অধিকার রক্ষায় অপরিহার্য।
যাকাত আদায় করা এবং ইসলামী সরকারের বিধান মেনে চলা প্রত্যেক মুসলিমের মৌলিক কর্তব্য।
যাকাত আদায় না করলে আখেরাতের শাস্তি
ইসলামী শরীয়তে যাকাত আদায় শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব নয়, বরং একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তব্য। যাকাত আদায়ে বাধা প্রদান বা তা পরিশোধে অবহেলা করলে ইসলামী প্রশাসন কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর উদ্দেশ্য হলো দরিদ্রদের অধিকার রক্ষা এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।
কুরআন থেকে দলীল
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
— (সূরা আত-তারিক, আয়াত ৩৫)
অর্থ:
“আর যারা স্বর্ণ-রূপা জমা করে রাখে এবং আল্লাহর পথে তা খরচ করে না, তাদেরকে ব্যথাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও।”
হাদিস থেকে দলীল
مَن مَنَعَ زَكَاةَ مَالِهِ فَسَوْفَ يُعَذِّبُهُ اللَّهُ بِهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ
— (সহীহ মুসলিম)
অর্থ:
“যে ব্যক্তি তার মাল থেকে যাকাত দিতে বিরত থাকে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিনে তার সেই মাল দিয়ে শাস্তি দেবেন।”
ইসলামী প্রশাসনের শাস্তি
ইসলামী শাসক যাকাত আদায়ে বাধা প্রদান বা দুর্নীতি করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, যেমন:
- অর্থদণ্ড বা জরিমানা
- সম্পদ বাজেয়াপ্ত
- কারাদণ্ড
- সামাজিক নিষেধাজ্ঞা
এসব ব্যবস্থা সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও দরিদ্রদের অধিকার রক্ষায় অপরিহার্য।
যাকাত আদায় করা এবং ইসলামী সরকারের বিধান মেনে চলা প্রত্যেক মুসলিমের মৌলিক কর্তব্য।
যাকাত আদায় না করলে আখেরাতে কঠিন শাস্তি হবে। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহতে এ বিষয়ে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দলীল তুলে ধরা হলো।
কুরআনের আয়াতসমূহ
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
يَوْمَ يُحْمَىٰ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ
هَٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ
— সূরা আত-তাওবা (৯), আয়াত ৩৪-৩৬
অর্থ:
“আর যারা সোনা ও রূপা জমা করে রাখে এবং আল্লাহর পথে তা খরচ করে না, তাদেরকে ব্যথাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। যেদিন তা জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে, অতঃপর তা দ্বারা তাদের কপাল, পার্শ্ব ও পিঠে সেঁক দেওয়া হবে। এটাই তোমরা নিজেদের জন্য জমা করেছিলে, সুতরাং তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ উপভোগ কর।”
তাফসীর থেকে উদ্ধৃতি
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
“পুঞ্জীভূত সম্পদ বলতে বোঝানো হয়েছে সেই সম্পদ যার ওপর যাকাত আদায় করা হয়নি।”
— (আল-হাদিস)
হাদিসসমূহ
مَن مَنَعَ زَكَاةَ مَالِهِ فَسَوْفَ يُعَذِّبُهُ اللَّهُ بِهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ
يُحْمِلُهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ ثُمَّ يُحْمِلُهَا فِي ذُنُوبِهِ حَتَّى يُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ أَوْ يَهْلِكَ
— সহীহ মুসলিম, হাদিস নং: ১৬৬৯
অর্থ:
“যে ব্যক্তি তার সম্পদের যাকাত দিতে বিরত থাকে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন তার ওই সম্পদ দিয়ে শাস্তি দেবেন। তা জাহান্নামের আগুনে বহন করানো হবে, তারপর গুনাহের বোঝা হিসেবে বহন করবে যতক্ষণ সে জান্নাতে প্রবেশ করে অথবা মরে যায়।”
আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেন:
إِنَّ اللَّهَ يُعْطِي الصَّدَقَةَ مِثْلَهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَوْ يُعَذِّبُهَا فِي جُسُومِ أَهْلِهَا
— সহীহ বুখারী, হাদিস নং: ২৩৩৯
অর্থ:
“যিনি যাকাত দান করবেন না, কিয়ামতের দিনে তার সম্পদ বিষের তীব্রতায় সাপের আকৃতি ধারণ করবে এবং তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।”
জাহান্নামে যাওয়ার একটি কারণ
পবিত্র কুরআনে আল্লাহতালা বলেন:
অর্থ:
“জাহান্নামের রক্ষীরা বলবে, তোমাদের কে জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করালো? তারা বলবে, আমরা সালাত আদায়ে গাফেল ছিলাম এবং দরিদ্রদের জন্য খাবার দিতাম না।”
— সূরা মুদ্দাছছির, আয়াত ৪২-৫২
যাকাত আদায় না করা শুধু দুনিয়ায় নয়, আখেরাতেও কঠিন শাস্তির কারণ। তাই আল্লাহর হুকুম মেনে যথাসময়ে যাকাত আদায় নিশ্চিত করা মুসলমানের একান্ত কর্তব্য।
ইসলামী শরীয়তের যাকাতের গুরুত্ব ও অবস্থা
যাকাত ইসলামের পাঁচটি প্রধান স্তম্ভের একটি। নামাজ এবং ঈমানের পর যাকাতের অবস্থান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র কোরআনে বহু জায়গায় সালাত ও যাকাতকে একসাথে উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকেই মনে করেন নামাজ ও রোজার গুরুত্ব বেশি, কিন্তু কোরআনে যাকাতের সঙ্গে সরাসরি নামাজের মিল আছে, রোজার নয়। এর পেছনে একটি গভীর অর্থ নিহিত রয়েছে।
যখন সালাতের সময় ধনী এবং দরিদ্র একসঙ্গে আমীন বলে দাঁড়ায়, তখন ধনীরা দরিদ্রদের পরিস্থিতি অনুভব করে এবং তাদের সাহায্যে উদ্বুদ্ধ হয়। এই সামাজিক সংযোগের মাধ্যমে সালাত ও যাকাত একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। তাই কোরআনে সালাতের পরে যাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইসলাম পাঁচটি মূল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে:
১) আল্লাহর একত্ববাদ স্বীকার করা,
২) সালাত কায়েম করা,
৩) যাকাত আদায় করা,
৪) রমজানের সিয়াম পালন করা,
৫) এবং হজ্জ করা।
— (সহীহ মুসলিম: হাদিস নং ১৯, সহীহ বুখারী: হাদিস নং ৮, তিরমিজি: হাদিস নং ২৬০৯)
এই কারণেই নবী করিম (সা.) সাহাবাদের মধ্যে যাকাতের জন্য বিশেষ বাইয়াত নিতেন। জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (সা.) থেকে সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা এবং প্রত্যেক মুসলিমের জন্য কল্যাণকামী হওয়ার ব্যাপারে বাইয়াত নিয়েছিলাম।
— (সহীহ বুখারী: হাদিস নং ১৪০৮)
সুতরাং, যাকাত শুধুমাত্র একটি আর্থিক ইবাদত নয়, এটি ইসলামী সমাজে সামাজিক সাম্যের প্রতীক এবং গরিব ও দরিদ্রের পাশে দাঁড়ানোর মৌলিক মাধ্যম। এর মাধ্যমে সমাজে সম্পদের সঠিক বন্টন সম্ভব হয় এবং মানবিক মূল্যবোধ বজায় থাকে।
যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ
ইসলামে যাকাত আদায় একটি অপরিহার্য বিধান। যারা যাকাত দিতে অস্বীকার করে, তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যুদ্ধ করার কঠোর আদেশ দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ ۗ
— সূরা তওবা, আয়াত ১১
অর্থ:
“অতএব, যদি তারা তওবা করে, নামাজ আদায় করে এবং যাকাত প্রদান করে, তবে তারা তোমাদের ধর্মে ভাই।”
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে, যাকাত আদায় না করলে তারা মুসলিম ভাই নয়, বরং আল্লাহর আদেশ অমান্যকারী হিসেবে গণ্য হবে।
হাদিসের বর্ণনা
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন:
"أُمرت أن أقاتل الناس حتى يشهدوا أن لا إله إلا الله وأن محمدًا رسول الله ويقيموا الصلاة ويؤتوا الزكاة"
(সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
অর্থ:
“আমাকে আদেশ দেওয়া হয়েছে মানুষকে যুদ্ধ করার জন্য যতক্ষণ তারা সাক্ষ্য দেয় যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল এবং তারা নামাজ কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে।”
ইতিহাসের প্রেক্ষাপট: আবু বকর (রা) ও যাকাত যুদ্ধে নেতৃত্ব
রাসূল (সা)-এর ওফাতের পর, যখন আবু বকর সিদ্দিক (রা) মুসলিম উম্মাহর খলিফা হন, তখন বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয়, যেমন:
- মুরতাদ বা ধর্ম ত্যাগকারীদের বিদ্রোহ
- মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র
- ভণ্ড নবীদের আবির্ভাব
- যাকাত দিতে অস্বীকারকারীরা
এসব সমস্যা মোকাবেলায় সর্বপ্রথম আবু বকর (রা) যাকাত দিতে অস্বীকারকারী মুরতাদদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। এই যুদ্ধকে ইতিহাসে “যাকাত যুদ্ধ” (যুদ্ধের নাম: যামাআতুল মুরতাদাহ) বলা হয়।
এ থেকে স্পষ্ট হয়, যাকাত আদায়ের গুরুত্ব অপরিসীম এবং যাকাত অস্বীকারকারীরা ইসলামী শাসনের জন্য বড় হুমকি।
যাকাত আদায় করলে আমাদের লাভ
১) যাকাত দাতার দানে মালের পরিশুদ্ধি হয়
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ফরমিয়েছেন:
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ ۖ إِنَّ صَلَاتَكَ سَلْسَلَةٌ لَهُمْ
— (সূরা তাওবা, আয়াত ১০৩)
অর্থাৎ, “তাদের সম্পদ থেকে সদাকাহ (যাকাত) গ্রহণ কর, এর মাধ্যমে তাদের পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করবে, এবং তাদের জন্য দোয়া কর; নিশ্চয়ই তোমার দোয়া তাদের জন্য শান্তিদায়ক।”
উপরোক্ত আয়াত থেকে স্পষ্ট হয়, যাকাত প্রদানের মাধ্যমে একজন মুসলমানের মালের পরিশোধন ঘটে। অর্থাৎ, যাকাত পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতার একটি মাধ্যম। যেভাবে শারীরিক পরিচ্ছন্নতা আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখে, তেমনি যাকাত আমাদের সম্পদকে পবিত্র করে আল্লাহর বরকত বৃদ্ধি করে। এছাড়াও, যাকাত দাতার জন্য নবী করিম (সা)-এর দোয়া প্রশান্তিদায়ক ও কবুলযোগ্য হয়। অন্যদিকে, যাকাত আদায়ে কৃপণতা বা অবহেলা করলে নবীর দোয়াও তাদের জন্য কবুল হবে না।
২) যাকাত দাতার মাল বৃদ্ধি পায়
হজরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَا مِنْ صَدَقَةٍ تَبْدَؤُهَا بِالنَّوْرِ، فَأَحَبَّ إِلَى اللَّهِ مِنْهَا، مِنْ صَدَقَةٍ يَدْفَعُهَا بِالْيَمِينِ، فَتُؤَجَّلُ، حَتَّى يَأْتِيَ بِالْمَدْحُورِ، كَمَا يُرْبَى أَحَدُكُمْ فَلَحَهُ، حَتَّى يَصِيرَ كَالْجَبَلِ، أَوْ أَفْضَلَ
— (সহীহ বুখারী হা: ৭৪২৯, সহীহ মুসলিম হা: ২৩৯০)
অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি হালাল ও পবিত্র আয় থেকে একটি খেজুর পরিমাণ সদাকাহ (যাকাত) দান করে, আল্লাহ তা’আলা তা নিজের ডান হাতে গ্রহণ করেন এবং দানকারীকে সেই দানটির জন্য লালন পালন করেন, যেমন একজন লোক বকরের বাচ্চাকে লালন পালন করে; যতক্ষণ না তা পাহাড়ের সমান অথবা তার চেয়ে বড় হয়ে যায়।”
এখান থেকে স্পষ্ট, যাকাত দানকারী আল্লাহর পক্ষ থেকে তার দানের নেকি বৃদ্ধি লাভ করে। সামান্য যাকাত হলেও, তা আল্লাহর বরকত ও সাহায্যে অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়, যা পাহাড়ের সমান বা তার চেয়ে বড় হতে পারে।
সংক্ষেপে
- যাকাত মালের পরিশুদ্ধির মাধ্যমে দাতার সম্পদ আল্লাহর বরকত লাভ করে।
- নবী (সা)-এর দোয়া দ্বারা দাতার জীবন শান্তিময় হয়।
- সামান্য যাকাতও আল্লাহর হেফাজতে অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়।
- যাকাত দানে কার্পণ্য পরিত্যাগ করে বরং আল্লাহর পথে খরচ করলে জীবনে ও আখেরাতে কল্যাণ লাভ হয়।
তাই প্রত্যেক মুসলিমকে উচিত সচেতনভাবে যাকাত আদায় করা ও সময়মত প্রদান নিশ্চিত করা।
যাকাত দাতাকে আল্লাহ জান্নাত দান করবেন
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা যাকাত প্রদানকারীদের জন্য জান্নাতের বরকত বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন:
إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَعُيُونٍ
آَخِذِينَ مَا آتَاهُمْ رَبُّهُمْ إِنَّهُمْ كَانُوا قَبْلَ ذَلِكَ مُحْسِنِينَ
كَانُوا قَلِيلًا مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ
وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ
— সূরা আল-যারিয়াত, আয়াত ১৫-১৯
অর্থ:
"নিশ্চয়ই মুত্তাকীরা (পরহেজগাররা) ঝর্ণাধারার বাগানে থাকবে; তারা তাদের রব কর্তৃক প্রাপ্ত জিনিস খুশিতে গ্রহণ করবে। তারা আগে সৎকর্মশীল ছিল। তারা রাতের সামান্য অংশে ঘুমাতো এবং রাতে শেষ প্রহরে ক্ষমা প্রার্থনায় লিপ্ত থাকত। তাদের ধন-সম্পদে আছে দুঃস্থ ও বঞ্চিতদের জন্য অংশ।"
অর্থাৎ, যারা তাদের ধন থেকে আল্লাহর পথে ব্যয় করে, আল্লাহ তাদের জান্নাত দান করবেন। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সঠিক সম্পর্ক স্থাপন হয় এবং সমাজে মানবিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে।
আরো পড়ুনঃ সুবহানা রাব্বিয়াল আলা অর্থ কি? | অর্থ, তাৎপর্য, ব্যবহার ও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলামী অর্থনীতিতে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি সমাজ থেকে চুরি, ডাকাতি, নারী নির্যাতন, সুদসহ নানা জঘন্য অপরাধ দূর করতে সাহায্য করে।
রাষ্ট্র যদি সুপরিকল্পিতভাবে যাকাত ব্যবস্থা চালু করত, তাহলে সমাজ থেকে এসব অপরাধ অনেকটাই কমে যেত। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে এই অপরাধগুলো সংঘটিত হয়। যাকাত আদায় অনিয়মের কারণে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বিরাট বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে।
যদি যাকাত সঠিকভাবে আদায় ও বিতরণ করা যেত, তাহলে পৃথিবীতে ধনী-গরিবের এ বিশাল ব্যবধান কখনো হত না।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের এ বিষয়ে সচেতন করে আমল করার তৌফিক দান করুন, আমীন।
যাকাতের আটটি খাত কি কি
যাকাত ইসলামে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত, যা সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ন্যায়বিচার ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করে। কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী যাকাতের জন্য নির্ধারিত আটটি খাত আছে, যেখানে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা বৈধ। এগুলো হলো:
- ফকির (অত্যন্ত দরিদ্র)
- মিসকিন (যাদের প্রয়োজন আছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না)
- আমিল (যাকাত সংগ্রহ ও বন্টনের কর্মী)
- মুআল্লাফাতুল কুলুব (যাদের হৃদয় ইসলাম গ্রহণের দিকে প্রবণ করা হয়)
- রিকাব (দাস-মুক্তির জন্য)
- গারিমিন (ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি)
- ফি সাবিলিল্লাহ (আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়)
- ইবনুস সাবিল (মুসাফির/পথিক)
কত ভরি স্বর্ণ থাকলে যাকাত দিতে হয়
যাকাত কত প্রকার ও কি কি
- যাকাতুল মাল ও
- যাকাতুল ফিতর।
- সোনার যাকাত
- রুপার যাকাত
- নগদ অর্থের যাকাত
- ব্যবসায়িক পণ্যের যাকাত
- কৃষিজ উৎপাদনের যাকাত
- পশুসম্পদের যাকাত
- খনিজ ও ভূগর্ভস্থ সম্পদের যাকাত
- যাকাতুল ফিতর
কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ
- স্বর্ণ
- রৌপ্য
- নগদ অর্থ
- ব্যবসায়িক পণ্য
- গবাদি পশু (উট, গরু, ছাগল ইত্যাদি)
- কৃষিজ পণ্য
- খনিজ ও ভূগর্ভস্থ সম্পদ
- ভাড়ার মাধ্যমে অর্জিত আয়
লেখকের শেষ কথা
আজকের ব্লগে আমরা যাকাতের হুকুম, শর্ত, খাত, গুরুত্ব ও পরিণাম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। প্রিয় পাঠকগণ, যাকাত শুধুমাত্র একটি আর্থিক দায়িত্ব নয়, এটি মানবতার উন্নয়নের এক অনন্য হাতিয়ার।
যাকাত ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে, সমাজে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর সঠিক বাস্তবায়ন ইসলামী অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে এবং দারিদ্র্যের অবসানে ব্যাপক অবদান রাখে।
যাকাতের হুকুম, শর্ত ও খাত সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং কর্তব্যসাধনীয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও মূল্যবান বিষয় নিয়ে জানার জন্য আমাদের সঙ্গে থাকুন, ইনশাআল্লাহ।
যাকাত সম্পর্কিত ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর (FAQs)
১। যাকাত কি?
যাকাত হলো ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি আর্থিক ইবাদত, যা ধনী মুসলিমদের জন্য নির্দিষ্ট সম্পদের একটি অংশ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের দান করা ফরজ।
২। যাকাতের নিসাব কি?
নিসাব হলো সেই পরিমাণ সম্পদ যার উপরে যাকাত ফরজ হয়। সাধারণত ৮৫ গ্রাম সোনা বা তার সমমানের সম্পদ।
৩। যাকাত কবে ফরজ হয়?
যাকাত তখন ফরজ হয় যখন কোনো সম্পদ এক বছর (হিজরি চন্দ্রবর্ষ) পূর্ণ করে এবং নিসাবের পরিমাণে থাকে।
৪। কোন কোন সম্পদের ওপর যাকাত দিতে হয়?
সোনা, রূপা, ব্যবসার পুঁজি, পশুপাখি, ফসল, ধান্য, এবং জমা রাখা নগদ অর্থের ওপর যাকাত ফরজ।
৫। যাকাত কি শুধুমাত্র টাকা-টাকায় দিতে হয়?
না, যাকাত দিতে হয় নিসাবের সমপরিমাণ যেকোনো সম্পদ থেকে যেমন সোনা, রূপা, ব্যবসা পুঁজি, পশুপাখি ইত্যাদি।
৬। যাকাত কাকে দিতে হয়?
যাকাতের খাত আটটি, যাদের মধ্যে দরিদ্র, গরিব, ঋণগ্রস্ত, পথচারী, যাকাত সংগ্রহকারীরা অন্তর্ভুক্ত।
৭। যাকাত দিতে হলে কার অনুমতি লাগে?
যাকাত নিজেই আল্লাহর হক, তাই অনুগ্রহ বা অনুমতির প্রয়োজন নেই, তবে সমাজে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ থাকলে তাদের মাধ্যমে দিতে পারেন।
৮। যাকাত দিতে কিভাবে শুরু করবো?
প্রথমে নিজের সম্পদ নিরূপণ করে নিসাবের হিসাব করুন, তারপর নিসাবের ওপর যাকাতের ২.৫% হিসাব করে নির্ধারিত ব্যক্তিদের প্রদান করুন।
৯। যাকাত আদায় না করলে কী হয়?
দুনিয়াতে ও আখেরাতে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে, আল্লাহর ক্রোধ বৃদ্ধি পাবে।
১০। কেউ যাকাত দিতে অক্ষম হলে কী হবে?
যাকাত ফরজ ব্যক্তি যার সম্পদ নিসাবের নিচে অথবা দারিদ্র্য সীমার নিচে সে যাকাত থেকে মুক্ত।
১১। যাকাত দেওয়ার সময় নির্দিষ্ট কি?
যাকাত সাধারণত হিজরি বছর পূর্ণ হলে দেওয়া হয়, তবে তা যেকোন সময় দিতে পারেন।
১২। বিজনেস পুঁজি থেকে যাকাত কিভাবে দেব?
বিজনেসের নিকট সম্পদের হিসাব করে, ব্যবসার লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করে নিসাবের ওপর ২.৫% যাকাত দেন।
১৩। যাকাতের খাতগুলো কী কী?
আটটি: গরিব, দরিদ্র, যাকাত আদায়কারী, হৃদয় জয় করা, মুক্তি প্রার্থীরা, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর পথে যোদ্ধা, এবং পথচারী।
১৪। যাকাত কি অন্যের নামেও দেওয়া যাবে?
হ্যাঁ, আপনি চাইলে অন্য কারো পক্ষ থেকে বা পরিবারের জন্যও যাকাত দিতে পারেন।
১৫। যাকাতের মাধ্যমে সমাজে কী ধরনের পরিবর্তন আসে?
যাকাত সমাজে অর্থনৈতিক সমতা, দারিদ্র্য হ্রাস, মানবিক সম্পর্কের উন্নতি এবং অপরাধের হ্রাস ঘটায়।
আব্দুন নূর আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url