আম কত ধরনের হয়? বাংলাদেশের জনপ্রিয় আমের জাত, মৌসুম, পুষ্টিগুণ ও নিরাপদ আম কেনার নিয়ম
আমের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতাআম – নামটি শুনলেই জিভে জল চলে আসে। গ্রীষ্মকালীন এই ফলটি শুধুমাত্র তার স্বাদ বা ঘ্রাণের জন্য বিখ্যাত নয়, বরং এটি বাংলাদেশি সংস্কৃতি, অর্থনীতি, কৃষি ও রপ্তানির সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু আপনি কি জানেন, আম কত ধরনের হয়?
এ দেশে শতাধিক প্রজাতির আম রয়েছে, যার প্রত্যেকটির স্বাদ, গন্ধ, রঙ, উৎপত্তিস্থল ও চাষ পদ্ধতি আলাদা। এই ব্লগে আমরা জানবো বাংলাদেশের বিখ্যাত সব আমের জাত, বৈশিষ্ট্য, অঞ্চলভেদে জনপ্রিয় আম, কবে কোন আম বাজারে আসে, কিভাবে সেগুলো সংরক্ষণ করতে হয় এবং পুষ্টিগুণসহ নানা তথ্য।
পোস্টের সূচীপত্রঃ
ভূমিকাঃ
বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন ফলের রাজা – আম। শুধু স্বাদ বা ঘ্রাণ নয়, এই ফলটি
আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষি অর্থনীতি এবং আবেগের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে। গরমকাল
এলেই শহর থেকে গ্রাম, হাট থেকে অনলাইন শপ – সর্বত্র আমের জয়জয়কার। কিন্তু
অনেকেই জানেন না, আমাদের দেশে আম কত ধরনের হয় এবং সেগুলোর স্বাদ, গঠন, ঘ্রাণ
কিংবা চাষ পদ্ধতিতে কত বৈচিত্র্য রয়েছে।
বাংলাদেশে শতাধিক জাতের আম চাষ হয়, যার মধ্যে কিছু জাত দেশীয়ভাবে প্রচলিত,
আবার কিছু জাত উদ্ভাবিত। চাঁপাইনবাবগঞ্জের হিমসাগর থেকে শুরু করে দিনাজপুরের
ল্যাংড়া, রংপুরের হাড়িভাঙ্গা থেকে রাজশাহীর ফজলি – প্রতিটি আমের পেছনে রয়েছে
নিজস্ব ইতিহাস ও স্বাদগত বিশেষত্ব।
এই ব্লগ পোস্টে আমরা জানব, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার জনপ্রিয় আমের নাম, তাদের
মৌসুমি বৈচিত্র্য, পুষ্টিগুণ, চাষ পদ্ধতি এবং সংরক্ষণের উপায়। পাশাপাশি জানতে
পারবেন কোন আম কবে বাজারে আসে, কোন জাত বেশি রপ্তানি হয় এবং কিভাবে চিনবেন আসল
ও কৃত্রিমভাবে পাকানো আমের পার্থক্য।
চলুন, ফলের রাজা আম সম্পর্কে জানি আরও গভীরভাবে – কারণ এই একটি ফলই বহন করে
আমাদের দেশের খ্যাতি ও কৃষিপণ্য রপ্তানির এক উজ্জ্বল দিগন্ত।
🥭 আম কত ধরনের হয় – জনপ্রিয় জাত ও বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশে আমের জাতের সংখ্যা শতাধিক হলেও কিছু জাত ব্যাপক জনপ্রিয় এবং
বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নিচে উল্লেখযোগ্য আমের তালিকা এবং তাদের
বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো:
ক্র. | আমের নাম | উৎপত্তি জেলা | স্বাদ | আঁশ | রং | মৌসুম (বাজারে আসে) | বিশেষ বৈশিষ্ট্য |
---|---|---|---|---|---|---|---|
০১ | হিমসাগর | রাজশাহী, দিনাজপুর | অতিমিষ্ট | নেই | হালকা হলুদ | মে শেষ–জুন | রসালো, ঘ্রাণযুক্ত |
০২ | ল্যাংড়া | রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ | টক-মিষ্টি | হালকা | সবুজ | জুন | ঘন মাংসল, সহজে নষ্ট হয়না |
০৩ | গোপালভোগ | রাজশাহী, নওগাঁ | মিষ্টি | নেই | উজ্জ্বল হলুদ | মে | দ্রুত পাকে, বাজারে আগেই আসে |
০৪ | ফজলি | চাঁপাইনবাবগঞ্জ | মিষ্টি | সামান্য | হালকা হলুদ | জুলাই | আকারে বড়, রস কম |
০৫ | আম্রপালি | সারা দেশ | মিষ্টি | বেশি | কমলা-হলুদ | জুলাই | আঁশযুক্ত কিন্ত ঘ্রাণযুক্ত |
০৬ | আশ্বিনা | রাজশাহী | হালকা-মিষ্টি | নেই | হালকা-সবুজ | আগষ্ট | দেরিতে পাকে, সংরক্ষণযোগ্য |
০৭ | রানি পছন্দ | রাজশাহী | টক-মিষ্টি | নেই | হলুদ | মে-জুন | ছোট আকৃতি, স্বাদে অনন্য |
০৮ | লক্ষণভোগ | দিনাজপুর | মিষ্টি | নেই | হালকা হলুদ | জুন | পাতলা খোসাযুক্ত |
০৯ | হাড়িভাঙ্গা | রংপুর | টক-মিষ্টি | সামান্য | সবুজ | জুন | শক্ত, চিবিয়ে খাওয়া যায় |
১০ | মল্লিকা | চুয়াডাঙ্গা | মিষ্টি | অল্প | সবুজ | জুন-জুলাই | আধুনিক জাত, ঘ্রাণযুক্ত |
১১ | রত্না | ঝিনাইদহ | মিষ্টি | কম | গাঢ় হলুদ | জুলাই | গবেষণালব্ধ জাত, সংরক্ষণযোগ্য |
১২ | বারি আম-৪ | মেহেরপুর | মিষ্টি | নেই | গাঢ় হলুদ | জুন | বারি উদ্ভাবিত জাত |
১৩ | বারি আম-১১ | কুষ্টিয়া | হালকা-মিষ্টি | কম | হালকা হলুদ | জু্লাই | ছোট আকৃতির |
১৪ | নাবিল | রাজশাহী | মিষ্টি | নেই | সবুজাভ | মে | দ্রুত পাকে |
১৫ | বানানী | মেহেরপুর | মিষ্টি | অল্প | হলুদ | জুলাই | ভালো রপ্তানিযোগ্য |
১৬ | ফজর আলী | নওগাঁ | টক-মিষ্টি | কম | হলুদ | জুন | দেশীয় প্রজাতি |
১৭ | বোম্বাই | রাজশাহী | মিষ্টি | মাঝারি | উজ্জ্বল হলুদ | মে | পুরনো জাত, রসালো |
১৮ | বেনারসি | চাঁপাইনবাগঞ্জ | মিষ্টি | কম | গাঢ় হলুদ | মে | সুগন্ধি, সুমিষ্ট |
১৯ | গোলাপখাস | দিনাজপুর | মিষ্টি | নেই | হালকা হলুদ | জুন | গোলাপ ফুলের মতো ঘ্রাণ |
২০ | কলাবাউ | নাটোর | মিষ্টি | নেই | হালকা সবুজ | মে | দেশীয় জাত, অল্প সময় টেকে |
২১ | রুপালি | চাঁপাইনবাবগঞ্জ | হালকা মিষ্টি | অল্প | গাঢ় সবুজ | জুলাই | বাণিজ্যিক উৎপাদনে ব্যবহৃত |
২২ | সিন্দুরী | যশোর | অতিমিষ্টি | নেই | কমলা-লাল | জুন | রঙ ও ঘ্রাণে আকর্ষণীয় |
২৩ | লতাবাউ | টাঙ্গাইল | মিষ্টি | বেশি | সবুজ | মে-জুন | স্থানীয় ছোট জাত |
🔍 অতিরিক্তভাবে:
👉 বারি উদ্ভাবিত জাতগুলোর তালিকা ও বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য জানতে চাইলে
BARI - বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট
ওয়েবসাইটটি ঘুরে দেখতে পারেন। এটি সরকারি এবং নির্ভরযোগ্য সোর্স।
✍️ সংক্ষেপে:
বাংলাদেশে আমের জাতের এই বৈচিত্র্য শুধু কৃষির শক্তি নয়, আমাদের দেশের
খাদ্যসংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রপ্তানির অন্যতম চালিকাশক্তি। প্রতিটি অঞ্চলের
মাটি, পানি ও আবহাওয়াভেদে ভিন্ন ভিন্ন জাতের আমের স্বাদ ও গুণগত মান তৈরি
হয়েছে। এ যেন প্রকৃতির এক অনবদ্য উপহার।
বাংলাদেশে আমের ইতিহাস ও উৎপত্তি
আমের ইতিহাস শুধু একটি ফলের ইতিহাস নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার কৃষিসভ্যতা,
সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতিচ্ছবি। “আম কত ধরনের
হয়” এই প্রশ্নের গভীরে ঢুকতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে—কীভাবে এই ফলটি
বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠভাবে মিশে গেছে।
📜 প্রাচীন যুগে আমের চাষ
ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী, উপমহাদেশে আমের চাষ শুরু হয় প্রায় ৪ হাজার বছর আগে।
গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকার উর্বর ভূমি ছিল প্রাচীন আমগাছের আদর্শ আবাসস্থল। বৌদ্ধ
সাহিত্য ও প্রাচীন সংস্কৃতে আমের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই সময়েও রাজা-মহারাজারা
আম খাওয়ার পাশাপাশি আমগাছ রোপণকে পুণ্যকাজ হিসেবে বিবেচনা করতেন।
👑 মুঘল যুগ: আমের নতুন মাত্রা
বাংলাদেশে আম চাষের সুবিন্যস্ত রূপটি গড়ে উঠে মুঘল আমলে, বিশেষ করে সম্রাট
আকবরের সময়। তিনি নিজ উদ্যোগে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে আমবাগান স্থাপন করেন।
সেই সময় মুর্শিদাবাদ ছিল মুঘল প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, যা
বর্তমানে বাংলাদেশের রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের চাষ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত
করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, আকবরের প্রতিষ্ঠিত “লক্ষ বাগ” নামে একটি বিশাল আমবাগান
মুঘল আমলেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল – যার ঐতিহ্য এখনো বহন করে
ওই অঞ্চলের হিমসাগর ও ফজলি জাতের আম।
📈 ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে পরিবর্তন
ব্রিটিশরা আমকে একটি অর্থনৈতিক ফসল হিসেবে মূল্যায়ন করে। তাদের সময়ে আমের
সংরক্ষণ, রপ্তানি ও গবেষণা শুরু হয় সীমিত পরিসরে। পাকিস্তান আমলেও রাজশাহী
অঞ্চলে আমবাগান ও কৃষি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। তবে সবচেয়ে বড়
অগ্রগতি আসে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে।
🌱 স্বাধীন বাংলাদেশ ও আধুনিক কৃষি গবেষণা
১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ আম উৎপাদনে বৈজ্ঞানিক
পদ্ধতি চালু করে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI)
ও
বাংলাদেশ ফলিত কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BAFRU) বিভিন্ন উন্নত জাত উদ্ভাবন করে, যেমন:
- বারি আম-৪
- বারি আম-১১
- মল্লিকা
- রত্না
👉আপনি চাইলে বারি উদ্ভাবিত জাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন BARI-এর
অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে। এটি একটি নির্ভরযোগ্য সরকারি উৎস।
✍️ সংক্ষেপে:
বাংলাদেশে আম চাষের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। মুঘলদের হাত ধরে যে আমচাষ
সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল, তা আজ আধুনিক কৃষি গবেষণার মাধ্যমে শতাধিক জাতে বিস্তৃত
হয়েছে। প্রতিটি অঞ্চলের মাটি, পানি ও আবহাওয়ার কারণে জন্ম নিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন
স্বাদের আম, যা আজ জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের কোন জেলায় আম বেশি হয়?
বাংলাদেশে আম চাষ একটি বহুল প্রচলিত কৃষি কার্যক্রম। প্রায় প্রতিটি জেলাতেই
কিছু না কিছু আম জন্মালেও কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চল তাদের ভৌগোলিক অবস্থান,
আবহাওয়া, মাটি ও কৃষি অভিজ্ঞতার জন্য বিশেষভাবে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। মূলত এই
অঞ্চলগুলিই দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আম রপ্তানিরও বড় অংশ জোগান দেয়।
🥇 ১. চাঁপাইনবাবগঞ্জ: আমের রাজধানী
চাঁপাইনবাবগঞ্জকে বাংলাদেশের “আমের রাজধানী” বলা হয়। এই জেলার প্রায় প্রতিটি
পরিবারই কোনো না কোনোভাবে আমচাষের সঙ্গে জড়িত। এখানকার মাটি, জলবায়ু এবং
কৃষকদের অভিজ্ঞতা – সবকিছু মিলিয়ে এটি সর্বোচ্চ উৎপাদনের জেলা।
🎯 বিখ্যাত জাত: হিমসাগর, ফজলি, গোপালভোগ, আশ্বিনা
🌾 উৎপাদন: প্রায় ৩ লক্ষ টন প্রতি বছর
📍 উৎস: মহানন্দা নদীঘেরা অঞ্চলে সবচেয়ে ভালো আম উৎপন্ন হয়।
🥈 ২. রাজশাহী: ঐতিহ্যের ধারক
রাজশাহী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাশে অবস্থিত এবং ঐতিহাসিকভাবে আমচাষে সমৃদ্ধ।
এখানকার আম সারা দেশে খ্যাতিমান এবং জাতীয়ভাবে রপ্তানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বিখ্যাত জাত: লক্ষণভোগ, ল্যাংড়া, ফজলি
উল্লেখযোগ্য এলাকা: পুঠিয়া, গোদাগাড়ী, মোহনপুর
🥉 ৩. নওগাঁ: বৈচিত্র্যপূর্ণ উৎপাদন
নওগাঁ জেলায় রয়েছে নানা ধরনের আমগাছ ও নতুন জাতের আম। এখানকার আমের স্বাদ ও রঙ
ভিন্নতর। স্থানীয় বাজারে নওগাঁর আম বেশ জনপ্রিয়।
বিখ্যাত জাত: আম্রপালি, রানীপছন্দ, বারি-৪
উৎপাদন বেড়েছে সরকারি গবেষণা কার্যক্রমের ফলে
📍 ৪. দিনাজপুর: উত্তরাঞ্চলের আম ভাণ্ডার
দিনাজপুর জেলার হাড়িভাঙ্গা আম বেশ পরিচিত এবং একে 'উত্তরের ফজলি' বলা হয়ে থাকে।
সেখানকার মানুষ দেরিতে পাকানো জাত চাষে পারদর্শী।
জনপ্রিয় জাত: হাড়িভাঙ্গা, ল্যাংড়া, গোলাপখাস
জলবায়ুর কারণে এখানে দীর্ঘসময় ধরে আম বাজারে পাওয়া যায়
📍 ৫. মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা: উন্নত জাত চাষে অগ্রগামী
এই অঞ্চলে আমের আধুনিক জাত যেমন মল্লিকা ও বারি-আম ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে।
আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ও চাষিদের সচেতনতা বেড়েছে।
বিখ্যাত জাত: মল্লিকা, রত্না
রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের কেন্দ্র
🗺️ অন্যান্য উল্লেখযোগ্য জেলা
জেলা জনপ্রিয় জাত
যশোর লক্ষণভোগ, হিমসাগর
ঝিনাইদহ বারি-১১, আম্রপালি
টাঙ্গাইল দেশি জাত
কুষ্টিয়া ফজলি
রংপুর হাড়িভাঙ্গা
👉 জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও
নওগাঁ এই তিনটি জেলা মিলে দেশের প্রায় ৬০% আম উৎপাদন করে।
✍️ সংক্ষেপে:
বাংলাদেশে প্রায় সব জেলায় আম চাষ হলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ,
দিনাজপুর এবং মেহেরপুর এই পাঁচটি জেলা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এসব জেলার আলাদা
আলাদা জাতের আম শুধুমাত্র স্থানীয় বাজারেই নয়, বিদেশেও রপ্তানি হয়। ভৌগোলিক
নির্দেশক (GI) স্বীকৃতি পাওয়ার দিক থেকেও এগিয়ে রয়েছে এই অঞ্চলগুলো।
🗓️ কবে কোন আম বাজারে আসে?
বাংলাদেশে আমের মৌসুম সাধারণত মে মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত
বিস্তৃত। তবে বিভিন্ন জাতের আম আলাদা সময়ে পাকে এবং বাজারে আসে। নিচে
মাসভিত্তিক জনপ্রিয় আমের নামের তালিকা দেওয়া হলো:
📅 মে মাস: মৌসুমের শুরু
সময় আমের নাম বৈশিষ্ট্য
মে ১ম সপ্তাহ গোপালভোগ আঁশবিহীন, মিষ্টি, দ্রুত পাকে
মে মাঝামাঝি
হিমসাগর রসালো, অতিমিষ্ট
মে শেষ সপ্তাহ
লক্ষণভোগ পাতলা খোসা, ঘ্রাণযুক্ত
👉 এই সময়ের আমগুলো দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়, কারণ বাজারে তখনো আমের ঘাটতি থাকে।
📅 জুন মাস: মূল মৌসুম
সময় আমের নাম বৈশিষ্ট্য
জুন ১ম সপ্তাহ
ল্যাংড়া আঁশযুক্ত, টক-মিষ্টি
জুন মাঝামাঝি বেনারসি গাঢ় রঙ, সুগন্ধি
জুন শেষ
আম্রপালি আঁশযুক্ত, সংরক্ষণযোগ্য
সারামাস
হাড়িভাঙ্গা শক্ত ও দেরিতে নষ্ট হয়
👉 জুন মাসে বাজারে সবচেয়ে বেশি জাতের আম পাওয়া যায়। দাম তুলনামূলকভাবে কম
থাকে।
📅 জুলাই মাস: বড় আকৃতির আমের সময়
সময় আমের নাম
বৈশিষ্ট্য
জুলাই শুরু
ফজলি বড় আকৃতি, কম রস
জুলাই মাঝামাঝি
রানি পছন্দ ছোট আকৃতি, টক-মিষ্টি
জুলাই শেষ
মল্লিকা আধুনিক জাত, ঘ্রাণযুক্ত
👉 এই মাসে ফজলি আমের আধিপত্য থাকে বাজারে। অনেক সময় এটি রপ্তানিতেও ব্যবহৃত
হয়।
📅 আগস্ট মাস: মৌসুমের শেষপ্রান্ত
সময় আমের নাম বৈশিষ্ট্য
আগস্ট শুরু
আশ্বিনা দেরিতে পাকে, সংরক্ষণযোগ্য
আগস্ট শেষ বারি-১১,
রত্না ছোট
আকৃতি, মিষ্টি
👉 যারা দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণযোগ্য আম চান, তাদের জন্য এই সময়ের আম আদর্শ।
📊 মাসভিত্তিক সারাংশ চার্ট
মাস বাজারে পাওয়া যায় বিখ্যাত জাত
মে মৌসুম শুরু
গোপালভোগ, হিমসাগর
জুন সর্বোচ্চ সরবরাহ
ল্যাংড়া, আম্রপালি, হাড়িভাঙ্গা
জুলাই বড় জাত ফজলি, মল্লিকা
আগস্ট দেরিতে পাকা আশ্বিনা, বারি-১১
❗ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
সরকার নির্ধারিত তারিখের আগে আম নামানো আইনত নিষিদ্ধ। যেমন:
- হিমসাগর: ১৫ মে’র আগে নয়
- ল্যাংড়া: ২০ জুন
- ফজলি: ২৫ জুলাই
👉 এই তারিখগুলো কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ
অধিদপ্তর (DAE) থেকে ঘোষণা করে।
✍️ সংক্ষেপে:
বাংলাদেশে আমের মৌসুম দীর্ঘ হলেও প্রতিটি জাতের জন্য নির্ধারিত একটি “পাকা
মৌসুম” রয়েছে। সঠিক সময়ে আম সংগ্রহ ও বিক্রি করলে এর স্বাদ, ঘ্রাণ এবং গুণগত
মান অক্ষুন্ন থাকে।
বিশেষ করে মে থেকে আগস্ট – এই চার মাসকে বলা হয় বাংলাদেশের “আম-ঋতু”। এ সময়
প্রতিটি জাতের আম বাজারে আসার সাথে সাথে ভোক্তাদের আগ্রহ ও চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে
যায়।
আমের পুষ্টিগুণ – স্বাস্থ্য ও শরীরের জন্য উপকারিতা
বাংলাদেশের মানুষ আম ভালোবাসে মূলত তার স্বাদ, গন্ধ ও রঙের কারণে। কিন্তু খুব
কম মানুষ জানে যে আম শুধু একটি রসালো ফলই নয়, বরং এটি একটি পুষ্টির ভাণ্ডার।
এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ, ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা
শরীরের জন্য অনেকভাবে উপকারী।
🧪 আমে কী কী পুষ্টিগুণ থাকে?
আমের ১০০ গ্রাম সাধারণত নিচের উপাদানগুলো দিয়ে গঠিত:
উপাদান
পরিমাণ
ক্যালরি
৬০–৭০ কিলোক্যালরি
পানি ৮০–৮২%
কার্বোহাইড্রেট
১৪–১৬ গ্রাম
চিনি (ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজ)
১৩–১৫ গ্রাম
ফাইবার
১.৫ গ্রাম
প্রোটিন
০.৮ গ্রাম
ফ্যাট ০.৩ গ্রাম
ভিটামিন A
৫৪% RDA (প্রো-ভিটামিন A বিটা-ক্যারোটিন)
ভিটামিন C
৪৪% RDA
ভিটামিন E
সামান্য
পটাশিয়াম
১৬৮ মি.গ্রা
ক্যালসিয়াম
১১ মি.গ্রা
ম্যাগনেসিয়াম
১০ মি.গ্রা
💪 আম খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা
১. চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়
আমে থাকা বিটা-ক্যারোটিন দেহে ভিটামিন A তে রূপান্তরিত হয়ে দৃষ্টিশক্তি উন্নত
করে ও রাতকানা প্রতিরোধ করে।
২. ত্বক ও চুলের জন্য ভালো
ভিটামিন A ও C ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে এবং চুলের গঠন উন্নত করে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট স্কিন এজিং প্রতিরোধে সহায়তা করে।
৩. হজমে সহায়ক
আমে থাকা এনজাইম (যেমন: আমাইলেজ) হজমে সাহায্য করে এবং ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য
কমায়।
৪. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
ভিটামিন C ও অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী
করে। এটি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে।
৫. হৃদযন্ত্রের সুরক্ষা দেয়
পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হার্ট
অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়।
৬. ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক
আমে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Mangiferin, Quercetin) ক্যান্সার কোষের গঠন
প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
👉 ২০১৭ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ম্যাংগিফেরিন নামক উপাদানটি লিভার, কোলন
এবং স্তন ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধ করতে সক্ষম।
⚠️ সতর্কতা – অতিরিক্ত আম খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
যদিও আম পুষ্টিকর, তবুও অতিরিক্ত খেলে কিছু সমস্যাও হতে পারে:
সমস্যা কারণ
ওজন বৃদ্ধি উচ্চ চিনি ও ক্যালরি
ব্লাড সুগার বাড়া ডায়াবেটিস রোগীর জন্য
বিপজ্জনক হতে পারে
ত্বকে ফুসকুড়ি কিছু মানুষ আমে
অ্যালার্জিক
পেট ব্যথা বা গ্যাস অতিরিক্ত খেলে
হজমের সমস্যা হতে পারে
🔍 বিশেষ সতর্কতা: রিপেনিং কেমিক্যাল (যেমন: ক্যালসিয়াম কার্বাইড)
দেওয়া আম স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। তাই প্রাকৃতিকভাবে
পাকানো আম কিনুন।
👉 বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (BFSA) এর মতে, রাসায়নিক দিয়ে পাকানো আম
ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
✍️ সংক্ষেপে:
আম শুধু সুস্বাদু নয়—এটি শরীরের জন্য একটি পরিপূর্ণ ফল। চোখ, ত্বক, হৃদপিণ্ড,
হজম, রোগ প্রতিরোধসহ নানা উপকারিতা রয়েছে এই ফলের মধ্যে। তবে অতিরিক্ত খাওয়া,
বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য, ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। সুতরাং, পরিমাণমতো
খেলে আম হতে পারে আপনার সুস্থ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
✅ কিভাবে চেনা যাবে আসল ও রাসায়নিক-মুক্ত আম?
বর্তমানে বাজারে অনেক সময় কৃত্রিমভাবে পাকানো আম পাওয়া যায়, যা স্বাস্থ্যের
জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী আম দ্রুত পাকাতে ক্যালসিয়াম
কার্বাইড, ইথিফোন বা অন্যান্য রাসায়নিক ব্যবহার করেন, যা লিভার, কিডনি ও
স্নায়ুতন্ত্রের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
তাই আসল, নিরাপদ এবং প্রাকৃতিকভাবে পাকানো আম চেনার জন্য কিছু মূল লক্ষণ নিচে
উল্লেখ করা হলো:
🔍 রাসায়নিকযুক্ত আমের বৈশিষ্ট্য
বৈশিষ্ট্য বিবরণ
✅ খুব দ্রুত পাকানো গাছে পাকা নয়, এক
বা দুই দিনের মধ্যে একসাথে পাকানো হয়
⚠️ রঙে অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা বাহ্যিক
রঙ খুব বেশি উজ্জ্বল ও সমান—অনেক সময় কমলা বা হলুদে চকচক করে
⚠️ ঘ্রাণে কৃত্রিমতা প্রাকৃতিক গন্ধের
পরিবর্তে কেমন যেন কেমিক্যালের মতো গন্ধ
⚠️ টেক্সচারে অস্বাভাবিকতা বাইরের অংশ
নরম, কিন্তু ভিতরটা শক্ত অথবা গন্ধহীন
⚠️ কাঠাল পাতার মতো পোড়া গন্ধ কার্বাইড
ব্যবহার করলে এমন গন্ধ হতে পারে
🥭 প্রাকৃতিকভাবে পাকানো আমের বৈশিষ্ট্য
বৈশিষ্ট্য বিবরণ
✅ অসাম্য রঙ পুরো আমে রঙ সমান হয়
না—একটু হলুদ, একটু সবুজ, একটু বাদামি হতে পারে
✅ স্বাভাবিক গন্ধ ঘ্রাণে মিষ্টি ও
টাটকা আমের স্বাভাবিক সুবাস থাকে
✅ স্বাদে সতেজতা খেতে রসালো ও তাজা,
জ্বালাপোড়া বা অস্বাভাবিক স্বাদ থাকে না
✅ গায়ে কালো দাগ প্রাকৃতিক আমে মাঝে
মাঝে ছোট ছোট কালো দাগ থাকতে পারে
✅ ধীরে ধীরে পাকানো গাছে পেকে নামানো
বা ঘরে পাকা আমে সময় লাগে ৩–৫ দিন
🧪 কেমিক্যালযুক্ত আমে কী কী ক্ষতি হতে পারে?
👉 National Center for Biotechnology Information (NCBI)-এর গবেষণায় বলা
হয়েছে:
ক্যালসিয়াম কার্বাইডে থাকা অ্যাসিটিলিন গ্যাস স্নায়ুতন্ত্রের উপর প্রভাব
ফেলে।
ইথিফোন (Ethylene releasing agent) অতিরিক্ত হরমোন উৎপাদনের মাধ্যমে ক্যান্সার
কোষকে উত্তেজিত করতে পারে।
🔗 সূত্র: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4801970/
🛡️ নিরাপদ আম কিনতে করণীয়
বিশ্বস্ত উৎস থেকে আম কিনুন (যেমনঃ কৃষি মার্কেট, ভেজালমুক্ত বাজার)
অনলাইন অর্গানিক ফার্ম বা কৃষকের দোকান থেকে সংগ্রহ করুন
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (BFSA)-এর অনুমোদিত উৎস ব্যবহার করুন
ঘরে রেখে প্রাকৃতিকভাবে পাকার সুযোগ দিন
কখনোই চকচকে ও ঘ্রাণহীন আম এড়িয়ে চলুন
✍️ সংক্ষেপে:
আম কেনার সময় শুধু বাহ্যিক রঙ বা আকার নয়, ঘ্রাণ, স্বাদ ও উৎস বিবেচনা করাও
জরুরি। কারণ রাসায়নিক দিয়ে পাকানো আম শরীরের জন্য ক্ষতিকর এবং দীর্ঘমেয়াদে
বিপজ্জনক রোগের কারণ হতে পারে। সুতরাং, সতর্ক থেকে প্রাকৃতিক ও নিরাপদ আম কিনুন
এবং পরিবারসহ সুস্থভাবে উপভোগ করুন।
🗺️ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বিখ্যাত আম ও তাদের বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে আম চাষ হয়, তবে কিছু বিশেষ জেলা ও উপজেলা আছে যেগুলো
তাদের নিজস্ব জাতের আম, স্বাদ ও ঘ্রাণের জন্য বিখ্যাত। নিচে অঞ্চলভিত্তিক
উল্লেখযোগ্য আম এবং তাদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো:
🏞️ চাঁপাইনবাবগঞ্জ: “আমের রাজ্য”
বিখ্যাত আম: গোপালভোগ, লক্ষণভোগ, হিমসাগর, ফজলি, আশ্বিনা
বৈশিষ্ট্য: আঁশবিহীন, সুগন্ধি, রসালো
বিশেষত্ব: দেশের সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদন হয় এই জেলায়
🏞️ রাজশাহী
বিখ্যাত আম: লক্ষণভোগ, হিমসাগর, ল্যাংড়া
বৈশিষ্ট্য: টক-মিষ্টি, সুগন্ধি, খোসা পাতলা
বিশেষত্ব: আম রপ্তানির জন্য বড় হাব হিসেবে পরিচিত
🏞️ নওগাঁ
বিখ্যাত আম: গোপালভোগ, ফজলি, হাড়িভাঙ্গা
বৈশিষ্ট্য: রসালো, মিষ্টি, সংরক্ষণযোগ্য
বিশেষত্ব: দেশি ও রপ্তানিযোগ্য আমের অন্যতম উৎপাদক এলাকা
🏞️ দিনাজপুর
বিখ্যাত আম: হাড়িভাঙ্গা
বৈশিষ্ট্য: সুগন্ধি, শক্ত খোসা, সহজে নষ্ট হয় না
বিশেষত্ব: এই আম দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ও দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণযোগ্য
🏞️ মেহেরপুর
বিখ্যাত আম: আম্রপালি, মল্লিকা, বারি-৪
বৈশিষ্ট্য: আঁশযুক্ত, ছোট আকৃতির, আধুনিক জাত
বিশেষত্ব: কৃষি গবেষণার মাধ্যমে উন্নত জাত চাষে এগিয়ে
🏞️ সাতক্ষীরা
বিখ্যাত আম: বারি-১১, আশ্বিনা
বৈশিষ্ট্য: দেরিতে পাকে, দীর্ঘস্থায়ী
বিশেষত্ব: জলবায়ু অনুকূল হওয়ায় দেরিতে পাকা জাত চাষে লাভজনক
📍 অন্যান্য উল্লেখযোগ্য এলাকা:
জেলা/উপজেলা আমের নাম বৈশিষ্ট্য
ঝিনাইদহ
রানি পছন্দ
ছোট ও টক-মিষ্টি
যশোর মোহনভোগ আঁশবিহীন, নরম
খুলনা মল্লিকা আধুনিক জাত, গন্ধযুক্ত
পাবনা হিমসাগর গন্ধি, রসালো
🧭 মানচিত্রে বিখ্যাত আম এলাকা
(আপনি চাইলে এই অংশে Google Map Embed করা যেতে পারে যেখানে দেশের বিখ্যাত আম
উৎপাদক জেলার লোকেশন দেখানো হবে, যা SEO-র লোকাল সার্চের জন্য উপকারী।)
✍️ সংক্ষেপে:
বাংলাদেশের জেলাভিত্তিক বৈচিত্র্যময় আম সংস্কৃতি আমাদের কৃষি ও খাদ্য ঐতিহ্যের
অন্যতম দিক। প্রতিটি জেলার আমের স্বাদ, ঘ্রাণ ও রঙে রয়েছে ভিন্নতা, যা আমাদের
গর্বের বিষয়। তাই শুধুমাত্র বাজারে জনপ্রিয় নামই নয়, প্রতিটি জেলার নিজস্ব
জাতগুলোকেও গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা প্রয়োজন।
🧊 আম সংরক্ষণের ঘরোয়া ও আধুনিক পদ্ধতি
আম মৌসুমি ফল হলেও অনেকেই চায় সারা বছর এই সুস্বাদু ফল উপভোগ করতে। এজন্য দরকার
সঠিক সংরক্ষণ পদ্ধতি, যাতে আমের স্বাদ, ঘ্রাণ ও পুষ্টিগুণ ঠিক থাকে দীর্ঘদিন।
এখানে তুলে ধরা হলো কয়েকটি কার্যকর ঘরোয়া ও আধুনিক সংরক্ষণ কৌশল।
🏠 ঘরোয়া পদ্ধতিতে আম সংরক্ষণ
১. ফ্রিজে সংরক্ষণ (Refrigeration):
পাকা আম ধুয়ে পরিষ্কার করে ঠান্ডা জায়গায় রাখুন।
খোসা ছাড়িয়ে কিউব করে কনটেইনারে বা জিপলক ব্যাগে রেখে ডিপ ফ্রিজে সংরক্ষণ করলে
৩–৪ মাস ভালো থাকবে।
টিপস: কিউবগুলোর মাঝে লেবুর রস ছিটিয়ে দিলে রঙ বজায় থাকে।
২. আমের আচার তৈরি করে সংরক্ষণ:
কাঁচা আম, লবণ, সরিষার তেল ও মসলা দিয়ে আচার তৈরি করুন।
ভালভাবে শুকিয়ে কাচের বোতলে রেখে দিলে ১ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণযোগ্য।
৩. আমের জ্যাম/জেলি/মোরব্বা:
পাকা আম থেকে জ্যাম বা জেলি তৈরি করে গ্লাস জারে ভরে রাখলে ৬–৮ মাস পর্যন্ত
খাওয়া যায়।
৪. আমের রস সংরক্ষণ:
ব্লেন্ড করে রসের বোতলে ফ্রিজে রাখা যেতে পারে। তবে সংরক্ষণের জন্য লেবুর রস
অথবা চিনি ব্যবহার করলে ভালো থাকে।
🏭 আধুনিক পদ্ধতিতে আম সংরক্ষণ
১. IQF (Individual Quick Freezing):
এই পদ্ধতিতে কাটা আমগুলো দ্রুত হিমায়িত করা হয় – টেক্সচার ও স্বাদ অটুট থাকে।
এটি শিল্প পর্যায়ে রপ্তানি ও আম সারাবছর সরবরাহে ব্যবহৃত হয়।
২. Can Processing (টিনে সংরক্ষণ):
পেস্টারাইজেশন পদ্ধতিতে টিনজাত করে সংরক্ষণ করা হয়।
দীর্ঘ সময় মান ঠিক রেখে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা সম্ভব।
৩. ড্রায়িং (Dehydration):
সূর্য বা মেশিনে শুকিয়ে আমের স্লাইস তৈরি করে Dried Mango Slices হিসেবে
সংরক্ষণ করা হয়।
৪. ফ্রুট লেদার / আমসত্ত্ব:
পাকা আমের রস ঘন করে শুকিয়ে আমসত্ত্ব বানিয়ে রাখা যায় বছরের পর বছর।
📦 সংরক্ষণের সময় করণীয়
সবসময় পাকা, পরিস্কার ও ভালো আম বাছাই করুন।
সংরক্ষণের জন্য স্টেরিলাইজড কনটেইনার ব্যবহার করুন।
নির্দিষ্ট তারিখ ও ব্যাচ লিখে সংরক্ষণ করুন।
সংরক্ষণের আগে সামান্য লেবুর রস বা প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করলে ভালো থাকে।
📚 ট্রাস্টেড রিসোর্স
✍️ সংক্ষেপে:
সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে আম শুধু মৌসুমেই নয়, বরং সারা বছর খাওয়া সম্ভব। ঘরে
তৈরি আচার হোক কিংবা আধুনিক ফ্রিজিং পদ্ধতি – প্রতিটি পদ্ধতির আছে নিজস্ব
উপকারিতা। আমাদের উচিত এই পদ্ধতিগুলো শেখা এবং ব্যবহার করা যাতে দেশের আমশিল্পও
লাভবান হয়।
🥭 আমের পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্যের উপকারিতা
আম শুধু সুস্বাদু ফলই নয়, এটি একটি সম্পূর্ণ পুষ্টি ভাণ্ডার। এতে রয়েছে
বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ, ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা শরীরের নানা দিক থেকে
উপকার করে। নিচে আমের পুষ্টিগুণ ও এর স্বাস্থ্যগত সুবিধাগুলো বিস্তারিত দেওয়া
হলো:
আমের পুষ্টিগুণ
পুষ্টি উপাদান পরিমাণ (১০০ গ্রাম প্রতি) কার্যকারিতা
ক্যালরি
৬০-৭০ ক্যালরি শরীরের শক্তির উৎস
কার্বোহাইড্রেট
১৪-১৬ গ্রাম দ্রুত শক্তি সরবরাহ করে
ফাইবার
১.৫ গ্রাম হজমে সাহায্য করে, কোষ্ঠকাঠিন্য
কমায়
ভিটামিন সি
৪৪% RDA রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
ভিটামিন এ (বিটা-ক্যারোটিন) ৫৪%
RDA চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করে
পটাশিয়াম
১৬৮ মি.গ্রাম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
ম্যাগনেশিয়াম
১০ মি.গ্রাম নার্ভ ও পেশী সুস্থ রাখে
আম খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা
দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে
ভিটামিন এ এবং বিটা-ক্যারোটিন চোখের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত আম খেলে
রাতকানা এবং চোখের বিভিন্ন সমস্যা কমে।
ত্বক ও চুলের যত্নে সাহায্য করে
ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়, বার্ধক্যজনিত দাগ দূর
করে এবং চুলকে শক্তিশালী করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
ভিটামিন সি শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে মজবুত করে এবং বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে রক্ষা
করে।
হজমে সহায়ক
আমে থাকা এনজাইম যেমন আমাইলেজ হজমে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম হৃদযন্ত্রকে সুরক্ষা দেয় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে
সাহায্য করে।
ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক
আমে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধে সাহায্য করে।
সতর্কতা
অতিরিক্ত আম খাওয়া ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে কারণ এতে উচ্চ
মাত্রায় শর্করা থাকে।
রাসায়নিক দিয়ে পাকানো আম স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়, তাই প্রাকৃতিক আম কিনতে সচেতন
হওয়া উচিত।
উৎস ও গবেষণা
সংক্ষিপ্ত উপসংহার
আম আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এটি শরীরের পুষ্টি চাহিদা
পূরণ করে এবং বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করে। তাই মৌসুমে প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর
আম খাওয়া আমাদের জীবনের জন্য খুবই উপকারী।
উপসংহার
বাংলাদেশে আম একটি ঐতিহ্যবাহী এবং জনপ্রিয় ফল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন
প্রজাতির আম চাষ হয়ে থাকে, যার স্বাদ, রঙ, ঘ্রাণ এবং পুষ্টিগুণ ভিন্ন ভিন্ন।
বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর ও মেহেরপুর জেলার আম দেশের
মধ্যে সেরা মানের এবং রপ্তানির জন্য বিখ্যাত।
আমের মৌসুম সাধারণত মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত স্থায়ী হলেও সঠিক সংরক্ষণ পদ্ধতির
মাধ্যমে আম সারা বছর উপভোগ করা সম্ভব। আম পুষ্টিগুণে ভরপুর, যা দৃষ্টিশক্তি,
ত্বক, হৃদযন্ত্র এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তবে কৃত্রিম রাসায়নিক
প্রয়োগ ছাড়া প্রাকৃতিক ও নিরাপদ আম বেছে নেওয়া জরুরি।
সুতরাং, আসল ও স্বাস্থ্যকর আম বাছাই করে সঠিক সময়ে খেলে আপনি পাবেন সুস্বাদু ও
পুষ্টিকর ফল যা আপনার শরীরকে সুস্থ ও শক্তিশালী করবে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
১. আম কত ধরনের হয়?
বাংলাদেশে আমের শতাধিক জাত রয়েছে। এর মধ্যে হিমসাগর, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ফজলি,
আম্রপালি, লক্ষণভোগ, হাড়িভাঙ্গা, মল্লিকা ইত্যাদি প্রধান ও জনপ্রিয় জাত।
২. আম কখন বাজারে আসে?
বাংলাদেশে আম সাধারণত মে মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত পাওয়া
যায়। বিভিন্ন জাত আলাদা সময়ে বাজারে আসে, যেমন গোপালভোগ মে মাসে, ফজলি জুলাই
মাসে বেশি পাওয়া যায়।
৩. কিভাবে চেনা যাবে রাসায়নিক মুক্ত আম?
রাসায়নিকযুক্ত আম সাধারণত খুব দ্রুত পাকানো হয়, চকচকে ও অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হয়,
ঘ্রাণ কেমিক্যালি হয়। প্রাকৃতিক আম ধীরে ধীরে পাকানো হয়, রঙ সামান্য ভিন্ন হয়
এবং স্বাদে সতেজ থাকে।
৪. আম খাওয়ার উপকারিতা কি?
আম ভিটামিন এ, সি, পটাশিয়াম ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর। এটি দৃষ্টিশক্তি
উন্নত করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, হৃদরোগ কমায় এবং ত্বক-চুলের জন্য ভালো।
৫. ডায়াবেটিস রোগী কি আম খেতে পারবে?
ডায়াবেটিস রোগীদের আম খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা উচিত কারণ আমে শর্করার পরিমাণ
বেশি। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সীমিত পরিমাণে আম খাওয়া উচিত।
৬. আম কিভাবে সংরক্ষণ করা যায়?
আম ফ্রিজে রাখা, জ্যাম বা আচার বানিয়ে সংরক্ষণ, দ্রুত হিমায়িত করা (IQF) ও
শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। সংরক্ষণের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে পচন বা
নষ্ট না হয়।
৭. রাসায়নিক দিয়ে পাকানো আম কি নিরাপদ?
না, রাসায়নিক দিয়ে পাকানো আম শরীরের জন্য ক্ষতিকর এবং বিভিন্ন রোগের কারণ হতে
পারে। তাই প্রাকৃতিক ও নিরাপদ আম কেনা উচিত।
আব্দুন নূর আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url